আমেরিকার ‘দাদা হওয়ার দিন শেষ’! জয়শঙ্করের কথায় কিসের ইঙ্গিত?

সুবর্ণ প্রভাত অনলাইন ডেস্কঃআমেরিকা আর বিশ্বের ‘দাদা’ নয়। বরং তার প্রভাব এবং প্রতাপ ক্রমশ কমে আসছে। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে নিজের এমন পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জয়শঙ্কর বলেছেন, “আমি মনে করি, ঠান্ডা যুদ্ধের পর আমেরিকার যে আধিপত্য ছিল, আজকে তা শেষের পথে।”
টালমাটাল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জয়শঙ্করের এই পর্যবেক্ষণকে তাঁর ব্যক্তিগত মত বলতে নারাজ অনেকেই। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, জয়শঙ্করের বক্তব্যে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিদেশনীতির প্রতিফলন রয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, তবে কি আমেরিকার গুরুত্ব এবং অপরিহার্যতাকে আর স্বীকার করতে চাইছে না নয়াদিল্লি? তবে নানা কারণে নয়াদিল্লি এতটা চরম পথ নেবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
জয়শঙ্করের বার্তার মধ্যে বিদেশনীতিতে দিল্লির ‘আত্মনির্ভরতা’র সুরটি রয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। সম্প্রতি একাধিক বিষয় নিয়ে মতপার্থক্যের জেরে সাময়িক দূরত্ব বেড়েছে নয়াদিল্লি আর ওয়াশিংটনের মধ্যে। এই আবহে জয়শঙ্করের ওই মন্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
খলিস্তানপন্থী জঙ্গি নেতা গুরপতবন্ত সিংহ পন্নুনকে ‘হত্যা করার ষড়যন্ত্র’ নিয়ে আমেরিকার একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে ওয়াশিংটন-দিল্লির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে সম্প্রতি টানাপড়েন দেখা যায়।
আমেরিকার ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, পন্নুন-হত্যার ছকে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ জড়িত। ভারত গোড়া থেকেই বিষয়টি অস্বীকার করে এসেছে।
ঘটনাচক্রে, পন্নুন হত্যার ছক নিয়ে আমেরিকার যে অভিযোগ, তা খণ্ডন করে সরাসরি ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। সম্প্রতি এই বিষয়ে মুখ খুলে আমেরিকা জানিয়েছিল, ভারতের উচিত ‘অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে’ বিষয়টির তদন্ত করা।
রাশিয়ার অবশ্য বক্তব্য, পন্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্র করায় ভারতীয়দের যুক্ত থাকার যে অভিযোগ উঠছে, তা নিয়ে আমেরিকা এখনও কোনও ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ হাজির করতে পারেনি।
আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে টানাপড়েন, তার নয়া ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে ইরানের চাবাহার বন্দর। আগামী ১০ বছরের জন্য ইরানের চাবাহার বন্দর পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছে ভারত।
চাবাহারের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ায় আফগানিস্তান, ইরান হয়ে রাশিয়া পর্যন্ত জলপথ পরিবহণে আধিপত্য কায়েম করতে পারবে ভারত। পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে আফগানিস্তান এবং পশ্চিম এশিয়ায় পৌঁছতে বিকল্প রাস্তা হিসাবে কাজে লাগাতে পারবে এই বন্দরকে।
চাবাহার নিয়ে ভারত-ইরান চুক্তি প্রসঙ্গে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপাল ডেপুটি মুখপাত্র বেদান্ত পটেল হুঁশিয়ারির সুরে বলেন, ‘‘কেউ যদি ইরানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের কথা ভাবে, তা হলে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে হবে।’’
সম্প্রতি বণিকসভা ‘ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স’-এর একটি অনুষ্ঠানে নাম না করে আমেরিকা এবং পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির সমালোচনা করেন জয়শঙ্কর। আমেরিকার হুঁশিয়ারি নিয়ে জয়শঙ্করের বক্তব্য, চাবাহার বন্দর নিয়ে ভারত-ইরান চুক্তি গোটা এলাকাকে উপকৃত করবে। একই সঙ্গে তাঁর আর্জি, বিষয়টিকে যেন সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা না হয়।
২০২০ সালে তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়া ফলাফল বদলাতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জয়শঙ্কর বলেন, “যে সব দেশ ফলাফল বদলাতে আদালতে যায়, তারা আমাদের জ্ঞান দিচ্ছে যে, কী ভাবে নির্বাচন করাতে হবে।”
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলিকে একহাত নিয়ে তিনি বলেন, “ওরা প্রকাশ্যে কোনও দল বা প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে নেয়।” ঘটনাচক্রে, কয়েক দিন আগেই ভারতের লোকসভা ভোটে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা হচ্ছে বলে আমেরিকার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিল রাশিয়া। আমেরিকা অবশ্য সেই অভিযোগ খারিজ করে দেয়।
ঠান্ডা যুদ্ধের আগে থেকেই রাশিয়া ভারতের বিশ্বাসযোগ্য সঙ্গী। একাধিক বার আমেরিকার চোখরাঙানির সামনে রাশিয়ার ভরসার হাত ভারতের সঙ্গে থেকেছে।
আবার চলতি শতাব্দীর গোড়া থেকেই ধাপে ধাপে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনের মতো শক্তির প্রভাব কমাতে ভারতের গুরুত্ব টের পেয়েছে ওয়াশিংটনও।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর একদা দ্বিমেরুকৃত বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে আমেরিকা। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হওয়ার পর পুতিনের দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের ডাক দিয়েছিল আমেরিকা।
ওয়াশিংটনের সঙ্গে নিবিড় কৌশলগত সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও অবশ্য রাশিয়ার থেকে অশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রেখে গিয়েছে নয়াদিল্লি। এই নিয়ে প্রশ্ন উঠলে জয়শঙ্করের মুখে বার বার যে ব্যাখ্যাটি শোনা গিয়েছে, তা হল ‘জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার’।
এ কথাও স্মরণে রাখার মতো যে, জয়শঙ্কর প্রাক্তন কূটনীতিক। অতীতে আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাই তাঁর বিশ্ববিক্ষার কদর রয়েছে নির্দিষ্ট একটি মহলে। তাই তিনি যখন দাবি করছেন, আমেরিকার দাদাগিরির দিন শেষ, তখন তা বিশেষ অর্থবহ বলেই মনে করছেন অনেকে।-আনন্দবাজার

শেয়ার করুনঃ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

    রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
     
    ১০১১১২১৩১৪১৫
    ১৬১৭১৮১৯২০২১২২
    ২৩২৪২৫২৬২৭২৮