সুবর্ণ ইসলাম কর্ণার ডেস্ক : মানব সৃষ্টির মধ্যে তিনটি বিস্ময়কর ব্যতিক্রম রয়েছে। এর প্রথম ব্যতিক্রম দুনিয়ার প্রথম মানব হজরত আদমের (আ.) ক্ষেত্রে। দ্বিতীয়টি প্রথম মানবী হাওয়ার (আ.) সৃষ্টিতে। তৃতীয়টি হজরত ঈসা (সা.)-এর জন্মের ঘটনা। আল্লাহ হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন মাটি থেকে। আদম (আ.)-এর সঙ্গিনী হিসেবে তার পাঁজর থেকে সৃষ্টি করা হয় হাওয়া (আ.)-কে। বাবা-মা ছাড়াই সৃষ্টি করা হয় প্রথম মানব-মানবীকে। হজরত ঈসা (আ.)-এর মা থাকলেও বাবা ছিল না। আল্লাহর ইচ্ছায় কুমারী মাতা মারিয়াম তাঁকে জন্ম দেন কোনো পুরুষের স্পর্শ ছাড়াই।
আল কোরআনের সুরা মারিয়ামের ১৬ থেকে ৪০ নম্বর আয়াতে হজরত ঈসা (সা.)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর বর্ণনা কর এই কিতাবে উল্লিখিত মারিয়ামের কথা, যখন সে তার পবিবারবর্গ থেকে পৃথক হয়ে নিরালায় পুব দিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল, এরপর তাদের থেকে সে পর্দা করল। এরপর আমি তার কাছে আমার রুহকে পাঠালাম, সে তার কাছে পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল। মারিয়াম বলল, আল্লাহকে ভয় কর যদি তুমি মুত্তাকি হও, আমি তোমা থেকে দয়াময়ের শরণ নিচ্ছি। সে বলল, আমি তো তোমার প্রতিপালকের প্রেরিত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য। মারিয়াম বলল, কেমন করে আমার পুত্র হবে? যখন আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই। সে বলল, এ রূপেই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন এটা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমি তাকে এ জন্য সৃষ্টি করব, যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার কাছ থেকে এক অনুগ্রহ; এটা তো এক স্থিরকৃত ব্যাপার। এরপর সে গর্ভে তাকে ধারণ করল; এরপর তৎসহ এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল; প্রসববেদনা তাকে এক খেজুর গাছের তলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। সে বলল, হায়! এর আগে আমি যদি মরে যেতাম ও লোকের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম। ফেরেশতা তার নিম্নপাশ থেকে আহ্বান করে তাকে বলল, তুমি দুঃখ কোরো না, তোমার পাদদেশে তোমার প্রতিপালক এক নহর সৃষ্টি করেছেন। তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছকে নাড়া দাও, তা তোমাকে সুপরিপক্ব তাজা খেজুর দান করবে। সুতরাং আহার কর, পান কর ও চক্ষু জুড়াও। মানুষের মধ্যে কাউকে যদি তুমি দেখ তখন বোলো, আমি দয়াময়ের উদ্দেশে মৌনতা অবলম্বনের রোজার মানত করেছি, সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করব না। এরপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হলে তারা বলল, হে মারিয়াম! তুমি তো এক অদ্ভুত কান্ড করে বসে আছ। হে হারুন-ভগ্নি! তোমার বাবা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং মা ছিলেন না ব্যভিচারিণী। এরপর মারিয়াম সন্তানের প্রতি ইঙ্গিত করল। তারা বলল, যে কোলের শিশু তার সঙ্গে আমরা কেমন করে কথা বলব? সে (শিশু ঈসা) বলল, আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যত দিন জীবিত থাকি তত দিন সালাত ও জাকাত আদায় করতে। আর আমাকে আমার মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত ও হতভাগ্য; আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্ম লাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হব। এ-ই হলো মারিয়াম-তনয় ঈসা (আ.)।
সত্য কথা, যে বিষয়ে তারা বিতর্ক করে।’ সুরা মারিয়াম, আয়াত ১৬-৪০)। হজরত ঈসা (আ.) ছিলেন অন্য সব মানুষের মতো আল্লাহর বান্দা। তবে তিনি ছিলেন একজন রসুল। যার ওপর আল্লাহ ইনজিল কিতাব নাজিল করেন। আল্লাহ তাঁর এই প্রিয় রসুলকে অনেক মাজেজা দান করেন। উদ্দেশ্য ছিল অবিশ্বাসীদের মধ্যে আল্লাহর রসুল সম্পর্কে বিশ্বাস সৃষ্টি। আল্লাহর পথে যাতে তারা ফিরে আসে ও ইমান আনে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন তুমি কাদামাটি দিয়ে পাখির প্রতিকৃতির মতো প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে আমার আদেশে। এরপর তুমি তাতে ফুঁ দিতে; ফলে তা আমার আদেশে পাখি হয়ে যেত এবং তুমি আমার আদেশে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে নিরাময় করে দিতে এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদের বের করে দাঁড় করিয়ে দিতে এবং যখন আমি বনি ইসরাইলকে তোমাদের থেকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম, যখন তুমি তাদের কাছে প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে। এরপর তাদের মধ্যে যারা কাফির ছিল তারা বলল, এটা প্রকাশ্য জাদু ছাড়া কিছুই নয়। আর যখন আমি হাওয়ারিদের মনে জাগ্রত করলাম যে, আমার প্রতি এবং আমার রসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তখন তারা বলতে লাগল, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে আমরা আনুগত্যশীল।’ সুরা আল মায়িদা, আয়াত ১১০-১১১। হজরত ঈসা (আ.)-এর উম্মতদের অনেকে শয়তানের প্রলোভনে বিপথগামী হয়। তারা তাঁকে আল্লাহর অংশীদার বানিয়ে ইবাদত করার ধৃষ্টতা দেখায়। আল কোরআনে তাদের পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, ‘তারা কাফির, যারা বলে যে মারিয়াম-তনয় মসিহ-ই-আল্লাহ; অথচ মসিহ বলেন, হে বনি ইসরাইল, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমার প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থির করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হয় জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোনো সাহায্যকারী নেই।’ সুরা মায়িদা, আয়াত ৭২। আল্লাহ হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি ছিলেন দয়াশীল। ইহুদিরা আল্লাহর রসুলকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তবে তারা সফল হয়নি। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দা ও রসুলকে ঊর্ধ্বালোকে উঠিয়ে নেন। কিয়ামতের আগে তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত হিসেবে এবং স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন।