নিজস্ব প্রতিবেদন : ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ, সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যিনি সারাটি জীবন সংগ্রাম করে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, সেই কালজয়ী ক্ষণজন্মা পুরুষ মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী। যিনি মহাত্মা গান্ধী নামে সারা বিশ্বে পরিচিত। যিনি লালন-পালন করতেন অহিংসা পরম ধর্ম, সহিংসতাকে না বলুন এবং সহিংসতা কোনো সমাধান নয়। এ জীবন দর্শনগুলোর জন্য মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী মহাত্মা গান্ধী হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি পাক-ভারত উপমহাদেশের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
গান্ধীর জীবনী থেকে জানা যায়, মহাত্মা গান্ধী ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিম ভারতের গুজরাট প্রদেশের পোরবন্দর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রভাবশালী পিতা কাবা গান্ধী ও মাতা পুতলী বাঈ চেয়েছিলেন তাদের সন্তান প্রথিতযশা ব্যারিস্টার হোক। পিতা-মাতার সে আশা পূরণের জন্য মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী এন্ট্রান্স পাশ করে ১৯ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে যান। লন্ডন যাওয়ার আগে স্কুলজীবনে মাত্র ১৩ বছর বয়সে গান্ধীজীকে বিয়ে করানো হয় শিশু কন্তুরাবাকে। ছোটবেলায় পরিবার থেকে সত্য বলা ও তা দৃঢ়ভাবে পালনের উপর শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। লন্ডনে পড়ার সময় মায়ের আদেশে উদ্বুদ্ধ হয়ে সব আড়ম্বরপূর্ণ জীবন পরিত্যাগ করে অতি সাধারণ জীবনযাপনের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে নিরামিশ আহার করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। সেখান থেকে তিনি নিরামিশভোগীদের নিয়ে শাকাহার সোসাইটি গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে তিনি ব্যারিস্টারি পাশ করে বোম্বে হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করলেও তাতে কোনো সাফল্য লাভ করেননি।
১৮৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। তিনি সে সময় ব্রিটিশ শোষকগোষ্ঠীর নানাবিদ অমানবিক ও মানবাধিকার পরিপন্থী কাজের তীব্র বিরোধিতা ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আফ্রিকায় গমন করেন এবং দীর্ঘ ৮ বছর সেখানে অবস্থান করেন। এ আন্দোলনে সক্রিয় একজন নেতা হিসাবে সর্বজন স্বীকৃত মহাত্মা গান্ধী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে রাজনীতিতে তার অবস্থান দৃঢ় করেন। ১৯১৯ সালে ঐতিহাসিক সত্যাগ্রহের আন্দোলনের সূচনা করেন তিনি। সত্যাগ্রহের মূলমন্ত্র ছিল অহিংসা। তিনি বিশ্বাস করতেন সর্বোত্তম গুণ যা ভালোবাসা হতে উৎসারিত হয় এবং মানুষের হৃদয় পরিবর্তনের মাধ্যমে এ গুণ অর্জন করা সম্ভব। দেশের মানুষের প্রকৃত দুঃখ-দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার জন্য গান্ধিজী দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতেন। তিনি জেলে, তাঁতি, কুমার, কামার, কৃষক, মুচি ও মেথরসহ সর্বসাধারণের সঙ্গে কথা বলতেন এবং তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা চালাতেন। ১৯২৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বভারত কংগ্রেসের সভায় ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশদের ভারত ছাড় আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতবাসীদের একদফা আন্দোলনের সূচনা করেন।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পাক-ভারত স্বাধীন হবার পূর্বমুহূর্তে সর্বত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন জ্বলে উঠে। এ দাঙ্গার লেলিহান ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালীর নিভৃত পল্লী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জে ও নোয়াখালী এলাকায়। বহু লোকের প্রাণহানি ঘটে, ক্ষতি হয় অফুরন্ত সম্পদ। তখন গান্ধীজী ছুটে আসেন নোয়াখালীতে। ১৯৪৬ সালের ৭ নভেম্বর তিনি ট্রেনযোগে চৌমুহনী স্টেশনে এসে নামেন। তিনি প্রায় চার মাস সাহসিকতার সাথে নোয়াখালীতে অবস্থান করেন। এসময় তার সাথে এসে যোগ দেন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়র্দী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদসহ আরো অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। গান্ধীজী পায়ে হেঁটে নোয়াখালীর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান এবং অহিংসা পরমধর্মÑ এ বাণী প্রচার করতে থাকেন। তিনি ৪৭টি সভায় বক্তব্য রাখেন এবং শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এ চার মাস তিনি রামগঞ্জ ও বর্তমান সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগে রাত্রীযাপন করতেন। গান্ধীজী পছন্দ করতেন ছাগলের দুধ। সে সময় তার ছাগল চুরির ঘটনা নিয়ে নানা রসালো কথা ছড়িয়ে পড়লেও ছাগল চুরির সত্যতা আজো মেলেনি। নোয়াখালী থেকে অসুস্থ অবস্থায় ৭৭ বছর বয়োবৃদ্ধ গান্ধীজী ভারত ফিরে যান। তার ২ বছর পর ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মৌলবাদী উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দু জঙ্গী নাথুরাম গডসের গুলিতে নিহত হন তিনি। নোয়াখালীর প্রথম ব্যারিস্টার ও জমিদার হেমন্ত কুমার ঘোষ তার সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি গান্ধিজীকে উৎসর্গ করেন।
গান্ধীজীর স্মৃতিবিজড়িত জয়াগের স্থানটিকে ঘিরে এখন তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য তারই অনুসারীরা গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট গড়ে তুলেছেন। এ ট্রাস্ট জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। অর্ধলক্ষাধিক দরিদ্র পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও তাদের অধিকারের জন্য কাজ করছে এবং করে আসছে এ সংগঠন। এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা, মানবিক উন্নয়ন, হস্ত ও কুটিরশিল্প, মানবাধিকার, সুশাসন, আইসিসি ফর ডেভেলপমেন্ট এবং ওয়াটার এন্ড স্যানিটেশন কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। আশির দশক থেকে প্রতিষ্ঠানটির গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি বৃহত্তর নোয়াখালীতে সম্প্রসারিত হয়। এ ট্রাস্টকে ঘিরে একই স্থানে ২০০০ সালে গান্ধীজীর জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনের দুর্লভ ছবি ও বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র সংবলিত একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। নিরিবিলি এ পরিবেশে জাদুঘরে প্রতিদিন আসছেন দেশ-বিদেশের সুধীজন ও গুণীজনসহ অসংখ্য দর্শনার্থী। গান্ধীজীর নোয়াখালী আগমন ও পাক-ভারতের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে এমন কিছু দুর্লভ ছবি রয়েছে যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করছে।
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের একটি শক্তিশালী ট্রাস্টিবোর্ড রয়েছে। এ ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি হলেন মাননীয় বিচারপতি শ্রী সৌরেন্দ্র সরকার। অন্য সদস্যরা হলেন পদাধিকারবলে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক, বাংলাদেশস্থ স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এডভোকট মিজবাহ উদ্দিন সিরাজ, ড. কামরুল হাসান খান ও সচিব কৃষ্ণ দাসগুপ্ত। গান্ধীজীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যিনি জীবন ও যৌবনের বিলাসিতা বিসর্জন দিয়েছেন এ প্রতিষ্ঠানের জন্য, তার কথা স্মরণ না করলেই নয়। তিনি ছিলেন এ ট্রাস্টের প্রয়াত সচিব চিরকুমারী ঝর্ণা ধারা চৌধুরী। গত ২৭ জুন ২০১৯ সালে ৮৩ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর পূর্বেই তিনি তার দেহ দান করে যান চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নকল্পে এবং যা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়।
১৯৬৫ সাল থেকে তিনি এ ট্রাস্টের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি সচিব পদে মনোনীত হন। একজন সহজ-সরল ব্যক্তিত্বের এ নারী এলাকায় ঝর্ণাদি হিসেবে সবার কাছেই পরিচিত। তাকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করছেন আরেক সদালাপি পরিচালক রাহা নবকুমার। এ আশ্রমের প্রায় ১০০ জন বেতনভোগী কর্মচারী রয়েছেন। তারাও সবাই সমাজ গঠনে গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত। এ এলাকার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে অহিংসা ও শান্তি, মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে নতুন ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, একই সাথে ধর্ম-বর্ণ ও জাতিগোষ্ঠির মানুষের মধ্যে বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে সহায়তা এবং দারিদ্র্য বিমোচনের নতুন কৌশল উদ্ভাবনের ক্ষেত্র তৈরিসহ ক্ষুধামুক্ত, অহিংসা ও শান্তিময় সমাজ গঠনে প্রসংশনীয় পদক্ষেপ এ ট্রাস্টের। যা চোখে না দেখলে নয়।
নোয়াখালীতে গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত আশ্রম ও জাদুঘর
- সুবর্ণ প্রভাত
- জুলাই ৩০, ২০২১
- ১১:৩০ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুনঃ
সোনাইমুড়ী উপজেলা যুবদলের সভাপতি গ্রেফতার
•
নভেম্বর ২৯, ২০২৩
আয়কর বিবরণী জমার সময় বাড়লো দুই মাস
•
নভেম্বর ২৯, ২০২৩
ওবায়দুল কাদেরের পক্ষে মনোনয়নপত্র দাখিল
•
নভেম্বর ২৯, ২০২৩
- সর্বশেষ
- সর্বাধিক পঠিত
