নোয়াখালীর লোকসাহিত্য : শিশুতোষ অধ্যায়

Suborno provaat - Shuborno Provaat - সুবর্ণ প্রভাত
নোয়াখালীর লোকসাহিত্য

কাজী মানছুরুল হক খসরু : লোকজীবনের পরতে পরতে অর্থাৎ প্রতিদিনকার চাল-চলনে, বলনে-কথনে আবহমানকাল থেকে সাহিত্যের যেসব উপাদান-অনুসঙ্গ রয়েছে তাই লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্যের অধিকাংশই আবার অগ্রন্থিত। নির্ধারিত কোনো পুস্তক-পুস্তিকায় সেগুলো যেমন লেখাজোখা থাকে না, তেমনি আবার মুখে মুখে ফেরার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই ওগুলো কিছুটা বিকৃত ও পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। নোয়াখালী একটি সমৃদ্ধ সুপ্রাচীন জেলা। কাজেই এখানকার লোকসাহিত্যও যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও সবল। নোয়াখালীর লোকসাহিত্যের শিশুতোষ তথা শিশুসংক্রান্ত অংশ নিয়ে কিছু কথা বলার জন্যই এ আলোচনা। এর মাধ্যমে আমরা সাহিত্যের বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে কেবল নোয়াখালীর লোকসাহিত্যে শিশুতোষ ছড়া, ধাঁধা এবং প্রবচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবো।
শিশু যখন হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে আস্তে আস্তে তার নিজের জগতকে চিনতে-বুঝতে থাকে, তখন থেকেই দাদা-দাদি, নানা-নানি, খালা-ফুফু এদের কাছ থেকে বিভিন্ন গল্প, ছড়া, ধাঁধা, প্রবচন শুনে শুনে নিজেকে তার পরিবেশ উপযোগী করে তোলে। তাই সামাজিক কারণে আমাদের শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে লোকসাহিত্যের এসব উপাদানের গুরুত্ব অসামান্য। শুধু আমাদের অঞ্চল বা দেশের কথাই বা বলি কেন, দুনিয়ার তাবৎ শিশুদের কাছেই বাক্যের ছন্দময় উপস্থাপনা খুবই উপভোগ্য ও অনুকরণীয় বলেই প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই শিশুরা ছড়া, ধাঁধা প্রবচন এগুলো উপভোগ ও অনুকরণ করে থাকে। যদিও আজকের তথ্য-প্রযুক্তির দুনিয়ায় আমাদের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিশুরা এসব উপভোগের সুযোগ খুব একটা পায় না, তথাপি দেশের অধিকাংশ শিশুর জন্য এগুলোই সর্বাধিক উপভোগ্য। লোকসাহিত্যের শিশুতোষ ছড়াগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাবো প্রত্যেকটি ছড়াতেই লুকিয়ে আছে এক-একটি উপভোগ্য চিত্রকল্প, তেমনি ধাঁধা রয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত এবং প্রবচনে রয়েছে ভূয়োদশ।

নোয়াখালীর শিশুতোষ লোকছড়ার মধ্যে একটি ছড়া এ রকম :
ঝিঁ অঁ ঝিঁ অঁ মাগো
হেঁলা খাইতাম গেলাম গো,
কাঁডায় হুঁড়ি মইল্যাম গো;
কাঁডায় লইলো শুলানী
বুড়ইয়ায় লইলো দৌড়ানী॥

এ ছড়ায় আমরা যে চিত্রকল্প পাই তা হলো কোনো এক বুড়োর বাগানের ঝোঁপ থেকে পিয়ালা ফল তুলে খেতে গিয়ে যেই না কাঁটা ফুটলো অমনি বুড়ো টের পেয়ে ফল চোরকে দৌড়াতে শুরু করলো। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘লিচু চোর’ কবিতার অন্তর্গত ভাব আর নোয়াখালীর এ লোকছড়ার ভাবের তো কোনো পার্থক্য দেখি না। একইভাবে নোয়াখালীর আরেকটি লোকছড়া নজরুলের বিখ্যাত ‘কাঠবেড়ালী’ কবিতার সাথে তুলিত হতে পারে, যেমন :

কাউয়া কা কা কা
গাছে উডি গইয়া খা
এই ডাইলাত্তোন টককা দি
ওই ডাইলাত্ যা
টুককুর করি ওগ্গা গইয়া
আঁর লাই হালা।

এখানে খোকা বা খুকী কাককে পেয়ারা খেতে উৎসাহিত করছে এবং টুপ করে তার জন্যও একটা পেয়ারা ফেলার জন্য কাকটাকে অনুরোধ করতে দেখা যাচ্ছে।
নোয়াখালীর লোকছড়াগুলোর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন দেশী খেলার ‘বোল’। যেমন বৌচি, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট ইত্যাদি খেলার বোল যার মাধ্যমে অপর পক্ষকে জানান দেয়া হয় কার দম কতটুকু। এমন ছড়ার মধ্যে দু’একটি এ রকম :

১। থুক্কু মালা বো চিচি
কামরাঙা তুলশী, তুলশী…তুলশী

২। আঁর ছাবু মাইরলি
কোন খাদে খাদালি
খাদের নাম লট্কন
তোরে মাইত্যে কত্কন্ কত্কন্… কত্কন্

৩। ইয়ান কি?
আনা
তুই দেইক্লে তোর চোক কানা।

৪। এইটা কি?
মরিচ
এক্কই ডুবে
ধরিছ।

৫। আমি যামু আকাশে
জল খামু গেলাসে, গেলাসে…গেলাসে।

নোয়াখালীর ধাঁধাগুলোও বুদ্ধিদীপ্ত লোকছড়া বিশেষ যেমন :
১। কাগুজীলেবু সংক্রান্ত ধাঁধা
বনেত্তোন বার অইলো ভূতি,
ভাত রেড়াই দিলো মুতি॥

২। আনারস সংক্রান্ত
বনেত্তোন বার অইছে ভোঁজা,
হোন্দে লাডি মাতাত হোজা

৩। লাঙ্গল সংক্রান্ত
আঁডে কুর কুর
ছাঁডে মাডি
ছচোক তিন হুগুডি

৪। কবর সংক্রান্ত
ঘর আছে দুয়ার নাই,
মানষ আছে কথা নাই

৫। মশারী সংক্রান্ত
ঘরের ভিত্তে ঘর
হিয়ার ভিত্তে কুনকুইন্যা জর।

৬। মাটির হাঁড়ি সংক্রান্ত
লাল মিয়া আঁডে যায়,
হত্তোই আঁডে চোবাড় খায়॥

৭। মাকড়শা সংক্রান্ত
আষ্ট ঠ্যাং
হোল আঁডু
তার নাম রাম টাডু
হুনাত হাতি জাল
মাছ খায় চিরকাল।
উপযুক্ত ধাঁধাগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখবো যে, ছান্দসিকতার আড়ালে একেকটি বুদ্ধিদীপ্ত রহস্যময়তা শুধু শিশু কেন যে কোনো বয়সের মানুষকেই কম-বেশি নাড়া দেয়। নোয়াখালীর প্রবচনগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। অর্থাৎ দীর্ঘ দীর্ঘ সময়জুড়ে এ অঞ্চলের মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে আজকের শিশুকে আগামীদিনের উপযোগী করে গড়ে তোলার চেষ্টায় প্রবচনগুলোকে ব্যবহার করে আসছে। নোয়াখালীর এমনি হাজারো প্রবচনের কয়েকটি নিচে উল্লেখিত হলো :
১। হোলা নষ্ট আঁডে
মাইয়া নষ্ট ঘাডে
এ প্রবচনে ছেলেকে হাটে এবং মেয়েকে ঘাটে যেতে বারণ করা হচ্ছে। কারণ হাট বা বাজারে উঠে ছেলেরা যেমন ইঁচড়ে পাকা হয়ে উঠতে তেমনি ঘাটে অন্যান্য বয়স্ক মেয়েদের আড্ডায় পড়ে মেয়েশিশু বখে যেতে পারে।
২। বাপ আনমান বেডা
গাছ আনমান গোডা
মা আনমান ঝি
গাই আনমান ঘি।
শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে এ প্রবচনটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এ প্রবচনের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো ছেলে বাবার অনুসরণে এবং মেয়ে মায়ের অনুসরণে গড়ে উঠবে যাতে গাছ অনুযায়ী ফল হয়।
৩। মার বইন খালা
মাত্তোনো বালা,
বাপের বইন হু
কুত্তার লাইন রু।
সাধারণভাবে শিশুদের কাছে খালারা অত্যন্ত প্রিয় এবং ফুফুগণ তুলনামূলক অপ্রিয়, তাই সুযোগ মতো খালা শিশুকে যেমন আদর-যত্ন করে তেমনি শিশু মনে দীর্ঘস্থায়ী আসন করে নেয়ার জন্য ফুফুর প্রতি এ নেতিবাচক প্রবচন স্মরণ করিয়ে দেয় শিশুকে।
৪। বড়ের কতা লড়ে না
গজের দাঁত হড়ে না।
এ প্রবচনের মাধ্যমে শিশুকে এ শিক্ষা দেয়ার চেষ্টাই হয় যে, বড়দের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপ্রসূত এবং সাধারণভাবে তার ব্যতিক্রম হয় না।
৫। মায় কয়না মার হুত
মইয়ে কয় বইন হুত।
এ জগত সংসারে মা অপেক্ষা অন্য কেউ শিশুকে অধিক ভালবাসার কারণ নেই, তথাপি যখনই কেউ অধিক ভালোবাসার অভিনয় করে তখন বুঝে নিতে হয় যে ঐ মেকি ভালোবাসার আড়ালে নিশ্চয়ই কোনো অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে।
৬। ঘরের কতা বার কইল্যে
তারে কয় হর,
চৈত মাসে খেঁতা গাদ্দিলে
তারে কয় জ্বর।
এ প্রবচনটিতে শিশুকে প্রয়োজনীয় গোপনীয়তা রক্ষা করার শিক্ষাই দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আপন-পরের প্রভেদ বুঝানোর একটা প্রচেষ্টা রয়েছে।
৭। দেইকতো হারে না যারে,
হোলা দি বোলায় তারে।
শিশুতোষ এ সকল প্রবচন যে কেবল শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়; বরং প্রবচনগুলো থেকে শিশু পরবর্তী জীবন ও জগত সম্পর্কে একটি স্থায়ী ধারণা যাতে লাভ করে সে বিষয়গুলোও এ অঞ্চলের প্রবচনে বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিধৃত হয়েছে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি নোয়াখালীর লোকসাহিত্য ও লোকজীবনের শিশুতোষ অধ্যায়টি মোটেই অনুল্লেখ্য বা ফেলনা নয়। ব্যাপক গবেষণা ও সংকলন সম্ভব হলে নোয়াখালীর লোকসাহিত্যের শিশুতোষ অধ্যায়টি জাতীয় জীবনেও অবদান রাখতে সক্ষম।

লেখক : নোয়াখালীর লোকসাহিত্যের গবেষক ও আইনজীবী (জিপি)

শেয়ার করুনঃ

1,818 thoughts on “নোয়াখালীর লোকসাহিত্য : শিশুতোষ অধ্যায়”