
হায়দারী সুলতানা রেজিনা : আমার শৈশব ছিল মধুর ও মধুময়। আমরা যারা বাস করতাম মাইজদী শহরের পুরাতন হাসপাতাল সড়কে, এক কথায়- আমাদের বসবাসের এলাকাটি ছিল রাজনীতি ঘেরা। ভোর থেকে রাত অবদি এখানে পদচারণা ছিল সব ধরনের লোকের। আমার ফুপা মরহুম সেকান্দার উকিল সাহেব ছিলেন একাধারে বিজ্ঞ আইন প্রণেতা ও রাজনীতিবিদ। তিনিই ছিলেন বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আমার বাবা মাহফুজুর রহমানও ছিলেন তারই অনুসারী। এ পাড়াতে বাস করতেন ব্যবসায়ী, উকিল ও চাকরিজীবীরা। সবার সাথে সবার যেমন ছিল আত্মীয়তা, তেমনি ছিল আদর্শের মিল। বয়োঃজ্যোষ্ঠরা যেমন ছিলেন রাজনীতিবিদ, তেমনি পরবর্তী প্রজন্মরা আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। সহিদ উদ্দিন এস্কেন্দার কচি ভাই ও সাহাব উদ্দিন এস্কেন্দার ভুলু ভাই তাদেরই উদাহরণ। তারাই ছিলেন সবার আদর্শ। আমরা যারা ছোট- তারা নাচ, গান, অভিনয়, বক্তৃতায় শিক্ষানবীস। আমিও তার মধ্যে ছিলাম। স্কুলজীবনে ব্লু-বার্ড, হলদে পাখি ও গালর্স গাইডের লিডার ছিলাম। বক্তৃতা দেয়া ছিল আমার নেশা। আমার মা অত্যন্ত কঠোর শাসনে আমাদের ৫ ভাই-বোনকে মানুষ করেছিলেন। এতো শাসনের মাঝেও আমার ভাই (মাহবুব শরীফ) কিভাবে যে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন আমরা টেরও পাইনি। রাত করে ভাইয়ার ঘরে ফেরা আমাদেরকে চিন্তিত করতো। আম্মার ঝাড়া বকুনি খেয়ে ভাইয়া যখন খেতে বসতো তখন শুরু হতো দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা। তখন তো সবার ঘরে ঘরে পত্রিকা থাকতো না। ভাইয়া টাউনে গিয়ে পত্রিকা পড়ে আসতেন।
১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, ১৯৬৭ সালে ছাত্রলীগের নিউক্লিয়ার্স সদস্য, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুথান, পশ্চিমা শাসকের বৈরীভাব, ইয়াহিয়ার চক্রান্ত, জুলফিকার আলীর মিথ্যাচার- সব ওই বয়সে রপ্ত করেছি ভাইয়ার কাছ থেকে। এখান থেকে আস্তে আস্তে মনের মধ্যে রাজনীতি বাসা বাঁধে।
এরপর ’৭০-এর উত্তাল দিনগুলোর মধ্যে এসএসিসি পরীক্ষা শেষ করলাম। মনের মাঝে অসম্ভব চেতনা কলেজে যাব, তারপর রাজনীতি। রাজনীতি আর আমি- এ ছিল আমার স্বপ্ন। ’৭০-এর নির্বাচনে কচি ভাই (সহিদ উদ্দিন এস্কেন্দার) প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের জন্য মনোনয়ন পেলেন। সারা পাড়া হলো নিবার্চনমুখী। কচি ভাই নির্বাচনে জয়ী হলেন। কিন্তু তারই মাঝে ঝড় উঠলো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারবে না। ’৭০-এর নিবার্চন আমাদের কাছে রেফারেন্ডামের মতো ছিল। এরই মাঝে ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ- ‘এবারের সংগ্রাম, স্বধীনতার সংগ্রাম।’ যুদ্ধের শুরুতে আমরা নারীরা ’৭১-এর এপ্রিলের প্রথম দিকে আমাদের পাড়া থেকে একটি মিছিল বের করি। সে মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন আরজুমান বানু (কচি ভাইয়ের স্ত্রী) ও রেহানা ফারুক (দুইজনই প্রয়াত)। আমার হাতে ছিল বাংলাদেশের পাতাকা। মিছিল নিয়ে আমরা মাইজদী শহরের প্রধান সড়ক ও আবাসিক এলাকা প্রদক্ষিণ করি। পরদিন বাংলাদেশ অবজারভার ও সাংবাদে ছবি ছাপা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে আমার নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়। আমরা গ্রামে আশ্রয় নিই। কচি ভাই ও রশিদ মিয়াদের বাসাসহ আমাদের শহরের বাসায় পাকবাহিনীরা আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ৬ সেপ্টেম্বর আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাই সাহাবুদ্দিন এস্কেন্দার (ভুলু ভাই) আল-বদর ও রাজাকার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। পরিবারের বড় ভাইরা ভারতে। আমরা যারা দেশে আছি আজ এখানে তো, কাল ওখানে। প্রাণের ভয়ে রাতে বনবাঁদাড়ে আমাদের বসবাস ছিল।
দেশ স্বাধীন হলো। মিত্রবাহিনী ও আত্মীয়-স্বজনরা দেশে আসতে শুরু করলেন। আমার ভুলু ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী ও অবুঝ তিন সন্তান হারা ফুফুর কান্না থামাতে পারি না। দশ মাস চলে গেল- হঠাৎ একদিন কচি ভাই এসে তার মাকে (আমার ফুফু) বললেন, আম্মা বঙ্গবন্ধু আসবেন আপনাকে দেখতে। এই দশ মাসে প্রথম ফুফুকে দেখলাম একটু আনন্দিত হতে। নোয়াখালী শহরে সাজসাজ রব। আমাদের আগুনে পোড়া বাসাগুলো ঘষামাজা করে যে যার মতো বসবাস শুরু করলেন।
কচি ভাই এক সকালে আমাকে ডেকে বললেন, তোর না বঙ্গবন্ধুকে দেখার ইচ্ছে। বঙ্গবন্ধু আসছেন নোয়াখালীতে। বঙ্গবন্ধুর জন্য একটা বড় সাদা মালা তৈরি করতে হবে।
তখন ফুলের মালার প্রচলন হয়নি। ঘুড়ির সাদা কাগজ কেনা হলো। সুতো দিয়ে চার আঙ্গুল পরিমাণ কাগজ কেটে লম্বা লম্বা করে ভাঁজ করে দু’ধার আবার কেচি দিয়ে সরু সরু কুচি করা হলো। কচি ভাই মোটা সুতা নিজের গলার মধ্যে পরে মাপ দিলেন। চললো আমার মালা বানানো। ৪ দিনে এই মালা শেষ করলাম। মনে হলো জীবনে এরচেয়ে বড় তৃপ্তি আর পাইনি। মালাটি কচি ভাইয়ের হাতে তুলে দিলাম। ভাইয়া মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, খুব সুন্দর হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু নোয়াখালীতে আসলেন ১৯৭২ সালের ২২ জুন। সেদিন বিকেলে বঙ্গবন্ধু কচি ভাইয়ের মায়ের সাথে দেখা করতে এলেন। কি সুন্দর অবয়ব। দীপ্তময় চেহারা, তাঁর চশমার ফাঁকের দৃষ্টি যেন সূদুরপ্রসারী।
সাদা ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবী, তার উপরে মুজিব কোর্ট- যেন শুভ্রতার মাঝে অশুভকে ধ্বংস করার ইঙ্গিত। সবাই আমরা তাকিয়ে আছি। তাঁর চাহনি যেন কোটি কথার দৃষ্টি। ফুফুকে পায়ে ধরে সালাম করলেন। ফুফু বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললেন, বাবা আমার ভোলা (ভুলু) কই?
উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি তো আছি- চিন্তা করবেন না। আমাকে ডাকবেন, আমি সাড়া দেব। আপনার কি লাগবে জানাবেন।
সেদিন আপ্যায়নের জন্য বাসায় অনেক কিছু করা হলেও বঙ্গবন্ধু শুধু ডাবের পানি পান করলেন। স্বভাব সুলভ হাসি আর হাত তুলে সম্ভাষণ জানিয়ে আমাদের পাড়া থেকে বিদায় নিলেন। আমরা তাকিয়ে রইলাম গাড়িতে উঠা পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু আপনাকে আজো ভুলিনি-ভুলবোও না। যার জন্য বাংলাদেশের মুজিববাদী ছাত্রলীগের আমিই কো-এডুকেশনের জিএস পদে মনোনয়ন পেয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করি। এ শহরে একমাত্র মহিলা কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করি (পরবর্তীতে অনেকেই চাকরি করে)। কত লোভনীয় প্রস্তাব এসেছিল- কিন্তু রাজনীতির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হইনি। আজো একই মূলনীতি ধারণ করে আছি ও থাকবো।
জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সাবেক মহিলা সম্পাদিকা, নোয়াখালী সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ।