বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন

Shuborno Provaat - সুবর্ণ প্রভাত
মোহাম্মদ সোহেল চৌধুরী

মোহাম্মদ সোহেল চৌধুরী : দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে যেসব বীর আত্মত্যাগ করেছেন তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন। তিনি ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনীর বিমান হামলায় শহীদ হয়েছিলেন। দেশের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের মধ্যে তিনি একজন।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর বীরযোদ্ধারা যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করে একের পর এক শহর দখল করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করছিলেন, ঠিক সেই সময় ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ পানভেলসহ পদ্মা ও পলাশ সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট থেকে যাত্রা করে অপারেশন মংলা পোর্ট দখল এবং খুলনায় পাকিস্তান নৌঘাঁটি তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে রওনা করে। বড় কোনো বাধা ছাড়াই নৌবাহিনীর সদস্যরা মংলা পোর্ট দখল করে নেন। ৯ ডিসেম্বর নিজেদের অবস্থান সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করে নৌবাহিনীর সদস্যরা স্থল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মংলা পোর্টের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানী নৌঘাঁটি তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে সকাল এগারোটার দিকে মিত্রবাহিনী গানবোট পানভেলসহ পদ্মা, পলাশ দ্বারা গঠিত নৌবহর রূপসা নদীতে প্রবেশ করে। দুপুর বারোটার দিকে খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি নৌবহর এসে পৌঁছলে আকাশে ৪টি জঙ্গী বিমান দেখা যায়। শত্রুবিমান হিসেবে সনাক্ত করে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু নৌবহরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সামন্ত মিত্রবাহিনীর বিমান জানিয়ে তা আক্রমণ না করার নির্দেশ প্রদান করেন। কিছুক্ষণ পর বিমানগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়। নিশ্চিত পরাজয় জেনে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলো খুব নীচ দিয়ে উড়ে এসে সবার পেছনে থাকা পদ্মা জাহাজের উপর বোমাবর্ষণ করে। এতে অনেকে শহীদ ও আহত হন। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মিত্রবাহিনীর জাহাজ পানভেলের অবস্থানরত অধিনায়ক সামন্ত সকলকে জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। এই আদেশে কে বি এন এম পলাশের চিফ ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার রুহুল আমিন ক্ষিপ্ত হন এবং সকলকে অধিনায়কের নির্দেশ না শুনে জাহাজে অবস্থান করতে আহ্বান জানান। তখন তিনি সকলকে বলেছিলেন, আমাদের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। এর কিছুক্ষণ পর জঙ্গি বিমানগুলো পুনরায় ফিরে এসে পলাশে আক্রমন চালালে তাতে আগুন ধরে যায়। বিপজ্জনক মুহূর্তে পলাশে অবস্থানরত নাবিকরা জাহাজ ত্যাগ করেন। কিন্তু রুহুল আমিন জাহাজ পলাশের আগুন নেভাতে ও ভাসমান রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যান। তাকে জাহাজ ত্যাগ করতে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার রায়ের নির্দেশ প্রদান করলেও তিনি তা অমান্য করেন। হঠাৎ করে শত্রুদের গোলার একটি শেল তাকে মারাত্মকভাবে আহত করে। তার একটি হাত প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ সময় জাহাজে রক্ষিত গোলা-বারুদও বিস্ফোরিত হয়ে পুরো জাহাজে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তিনি জাহাজ থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এক হাত দিয়ে অনেক কষ্টে সাঁতার কেটে রুপসা নদীর তীরে এসে পৌঁছেন। আগেই নদীর তীরে ওঁৎপেতে থাকা পাকহানাদার ও তাদের দোসর রাজাকাররা তাকে ধরে ফেলে। পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে নদীর পাড়ে ফেলে রাখে। ১৪ ডিসেম্বর খুলনা শত্রমুক্ত হবার আগ পর্যন্ত নদীর তীরে তার লাশ পড়ে থাকে। এরপর স্থানীয়রা শহীদ রুহুল আমিনের মৃতদেহ উদ্ধার করে রূপসা নদীর তীরে ফেরী ঘাটের পার্শ্ববর্তী লকপুর নামক স্থানে সমাধিত করেন। শহীদ রুহুল আমিনের জয়াগ গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে ‘রুহুল আমিননগর’ এবং তার বাড়ির সামনে তার স্মরণে স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ (মরনোত্তর) উপাধিতে ভূষিত করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় শহীদ রুহুল আমিনের সমাধিসৌধ নির্মাণ করে।
শহীদ রুহুল আমিন স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে চট্টগ্রাম নৌঘাঁটির জাহাজ পিএনএস কুমিল্লাতে জুনিয়র কমিশন অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ’৭১ সালের ২০ মার্চ তিনি তার অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। এর ৫ দিন পর ২৫ মার্চ পাকিস্তানীরা নিরীহ বাঙালিদের উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তেজোদ্দীপ্ত, প্রখর বুদ্ধি ও দূরদর্শী রুহুল আমিন বাড়িতে থাকাকালীন অবস্থায় স্থানীয় ছাত্র-যুবক, শ্রমিক, রাজনৈতিক নেতা, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক সদস্যকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে থাকেন। ১৩ জুলাই তার স্ত্রী জাকিয়া খাতুন ৫ সন্তানকে রেখে মারা যান। এই অবস্থায় রুহুল আমিন তার দুই শিশুপুত্র ও তিন কন্যাকে রেখে ২০/২৫ জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে ভারতে যান। সেখান থেকে তিনি মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বাধীন ২নং সেক্টরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নৌবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ১০ নম্বর নৌ সেক্টর গঠন করে। তিনি চিফ ইঞ্জিন আর্টিফিসার হিসেবে এ সেক্টরে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এম এ জি ওসমানীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ছিল ১০ নম্বর নৌ সেক্টর। এ সেক্টরের অধীন বিএসএস পদ্মা ও বিএনএস পলাশ যুদ্ধ জাহাজ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই সময় রুহুল আমিন ও সহযোদ্ধারা পশুর নদীতে মাইন স্থাপন করে পাকিস্তানী নৌবাহিনীর জাহাজগুলোকে চলাচলে বাধা প্রদান করতে সফল হন। এ অসম্ভব সম্ভব হয়েছে রুহুল আমিনসহ নৌসদস্যদের বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতার কারণে।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন ১৯৩৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার তৎকালীন বেগমগঞ্জ উপজেলার (বর্তমানে সোনাইমুড়ী) দেউটী ইউনিয়নের বাগপাঁচড়া (বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিননগর) গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আজাহার পাটোয়ারী ও মাতা জুলেখা খাতুন। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন পিতা-মাতার সাত সন্তানের মধ্যে জ্যোষ্ঠ ছিলেন। তিনি নিজ গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষা শেষে আমিশাপাড়া কৃষক উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে মেট্রিকুলেশান পাস করেন। মেট্রিক পাশ করার পর কিছুদিন ঢাকার একটি পত্রিকা অফিসে কাজ করেন। পরে তিনি ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা কোর্সসম্পন্ন করার পর তিনি জুনিয়ার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পদে উন্নীত হন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারতযুদ্ধে কৃতিত্বের জন্য তাকে জুনিয়র কমিশন অফিসার পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন ছোটবেলা থেকে মেধাবী ও সাহসী ছিলেন। সুস্বাস্থ্য ও সুঠাম দেহের অধিকারী রুহুল আমিন ফুটবল, ভলিবল এবং সাঁতার কাটতে ভালোবাসতেন।
লেখক : জোষ্ঠ্য দোহিত্র (বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন)

শেয়ার করুনঃ

254 thoughts on “বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন”

  1. Vivian Fonseca, Tulane University School of Medicine, researched paths to ease symptoms of diabetic neuropathy.
    Does an online pharmacy pay for a ampicillin pediatric dosages , when we have the brand product you need?
    According to the latest American Heart Association’s Heart Disease and Stroke Statistics, about 6 million people 18 years and older in the United States have type 2 diabetes and do not know it.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

    রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
     
    ১০১১১২১৩১৪১৫১৬
    ১৭১৮১৯২০২১২২২৩
    ২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০