মহিয়সী ঝর্ণা ধারা চৌধুরী

Shuborno Provaat - সুবর্ণ প্রভাত
ঝর্ণা ধারা চৌধুরী
রাহা নবকুমার

রাহা নবকুমার : ১৯৪৬ সালে ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অব্যবহিত পরে মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালীতে আগমন করেন এবং সহকর্মীদের নিয়ে দাঙ্গাপীড়িত মানুষের মাঝে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় কাজ শুরু করেন। সেই সময় গান্ধীকর্মীদের সমাজসেবামূলক কাজ দেখে শ্রীমতি ঝর্ণা ধারা চৌধুরী উদ্বুদ্ধ হয়ে শিশু বয়সেই নিজেকে সমাজসেবায় উৎসর্গ করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথমেই তিনি লক্ষ্য করেন, অশিক্ষার কারণে সমাজের নারীরা চরমভাবে অবহেলিত ও নিগ্রহের শিকার হয়। এই উপলব্ধি থেকেই ১৯৫৩ সালে নারীদের শিক্ষার জন্যে তার বড় বোন কবিতা দত্তসহ রামগঞ্জের কালুপুরে ‘কল্যাণী শিক্ষায়তন’ নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। কিন্তু নারী শিক্ষা বিরোধীদের চক্রান্তে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামে অবস্থিত প্রবর্তক সংঘে যোগদান করেন। যেখানে শিক্ষিকা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে প্রবর্তক সংঘের প্রায় ৫ শতাধিক কিশোরীকে নিরাপদে ত্রিপুরার রিলিপ ক্যাম্পে নিয়ে যান এবং সেখানে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন।
প্রবর্তক সংঘে যোগদানের পরপরই তিনি সাধারণ দেশী চরকা ও অম্বর চরকার উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ সময় প্রবর্তক সংঘে চরকা ও তাঁতশিল্প পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
ঝর্ণা ধারা চৌধুরী এরপর ১৯৭৯ সালে বর্তমান গান্ধী আশ্রমে যোগদান করে হতদরিদ্র নারীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে হাজার হাজার নারীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন। গ্রামের হতদরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী হবার প্রধান হাতিয়ার হিসাবে তাদের হস্ত ও কুটির শিল্পের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান, আর্থিক সহায়তা ও উৎপাদিত পণ্য বিপণনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্থানীয় প্রজাতির মোস্তাক গাছের (পাটি পাতা) বাকল থেকে শীতল পাটি তৈরি, নারকেলের ছোবড়া থেকে পাপশসহ কাঁথা, কম্বল ইত্যাদি তৈরির মাধ্যমে এলাকায় ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেন। এরপর তিনি খাদি প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তুলা থেকে সুতা তৈরি করে তা থেকে কাপড় বুনে বাজারজাতকরণ শুরু করেন।
নিজের ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রীমতি চৌধুরী ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে খাদি ও অন্যান্য বিষয়ে কর্মরত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনপূর্বক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং গান্ধী আশ্রমের চলমান কর্মকা কে সমৃদ্ধ করেন।
গান্ধী আশ্রমের উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান সর্বজন বিদিত। এই প্রতিষ্ঠানের পণ্যসামগ্রী বিশেষতঃ বিভিন্ন ডিজাইনের থান কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে এবং যার কৃতিত্বের দাবীদার শ্রীমতি ঝর্ণা ধারা চৌধুরী।
গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে ব্যাপক প্রশংসা কুঁড়িয়েছেন এবং পুরষ্কার পেয়েছেন।
বাংলাদেশে খাদির পুনঃপ্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলাধীন নতুন মুন্সীরহাট নামক স্থানে ১৯৪৮ সাল অবধি তদানিন্তন পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বড় খাদি প্রতিষ্ঠান ছিল এবং এখান থেকে খাদি কাপড় পশ্চিমবঙ্গের সোদপুরসহ সারা ভারতে যেতো। কিন্তু ১৯৪৮-পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানের সব সম্পত্তি বেদখল হয়ে যায় এবং সককিছু লুটপাট হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ঘরবাড়িগুলো আগুনে পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়। শ্রীমতি ঝর্ণা ধারা চৌধুরীর তৎপরতায় নব্বইয়ের দশকে পুনরায় প্রতিষ্ঠানটিতে প্রাণসঞ্চার করা হয়। বর্তমানে সেখানে খাদি ও কাপড় উৎপাদনের কাজ চলছে এবং বহু নারী ও পুরুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়া কুমল্লিাস্থ অভয় আশ্রম পুনর্গঠনের কাজ চলছে শ্রীমতি চৌধুরীর নেতৃত্বে। খাদি ও হস্ত কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য ‘চরকা’ নামে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টে একটি গবেষণা ইউনিট খোলা হয়েছিল শ্রীমতি ঝর্ণা ধারা চৌধুরীর নেতৃত্বে। বর্তমানে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ৩৫টি তাঁত চলছে, যা শুধুমাত্র নারীদের দ্বারা পরিচালিত এবং যেখানে শতাধিক নারীকর্মী কর্মরত রয়েছেন।
শ্রীমতি ঝর্ণা ধারা চৌধুরী ১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার কালুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা আশালতা দেবী ও বাবা প্রমথ চৌধুরী। ব্যক্তিগত জীবনেম ঝর্ণা ধারা চৌধুরী চিরকুমারী, সংসারত্যাগী এবং মহাত্মা গান্ধীর ত্যাগের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্থ একজন সদালাপী মানুষ। মহাত্মা গান্ধীর ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি আজীবন খাদি কাপড় পরিধান করেছেন এবং নিরামিশ খাবার গ্রহণ করেছেন। তাঁর কাজের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজাজ পুরস্কার, ২০০০ সালে আমেরিকার ওল্ড ওয়েস্টবেরি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শান্তি পুরস্কার, ২০০১ সালে অনন্যা পুরষ্কার, ২০০৩ সালে দুর্বার নেটওয়ার্ক পুরষ্কার, ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিচ এন্ড কনফ্লিক্ট বিভাগ থেকে শান্তি পৃরষ্কার, ২০০৭ সালে সাদা মনের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি, ২০১০ সালে শ্রীচৈতন্য পদক, ২০১০ সালে চ্যানেল আই এবং স্কয়ারের যৌথ আয়োজনে কীর্তিমতী নারী, ২০১১ সালে রণবীর সিং গান্ধী স্মৃতি শান্তি সদ্ভাবনা পুরষ্কার, ২০১৩ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পুরস্কার, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বেগম রোকেয়া পদক, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় পুরষ্কার ‘একুশে পদক’ এবং ২০১৬ সালে ডেইলি স্টার কর্তৃক সম্মাননাসহ অসংখ্য পদক পেয়েছেন তিনি।
এই মহিয়সী নারী খুবই অসুস্থ অবস্থায় ২৭ জুন ২০১৯ সনে ৮৩ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর পূর্বেই তিনি তাঁর দেহ দান করে যান চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নকল্পে এবং যা পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়।
এই সর্বস্বত্যাগী সমাজকর্মীর প্রতি জানাই আমার শ্রদ্ধা ও প্রণাম।

লেখক : পরিচালক, গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট, নোয়াখালী।

শেয়ার করুনঃ

1,442 thoughts on “মহিয়সী ঝর্ণা ধারা চৌধুরী”