“উইল আই বি অ্যাবল টু সি ক্যাঙ্গারু’স ইন দ্যা স্ট্রিট?”
“ইট ডিপেন্ডস হাউ মাচ ইউ হ্যাভ বিন ড্রিংকিং!” বলেই হাসে জুলিয়ান।
তার হাসি ভ্রমণের ক্লান্তি ভোলানো স্নিগ্ধতা ছড়ায়। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প। স্বর্ণকেশি এ অস্ট্রেলিয়ানের বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। একজন পরিবেশবিদ। ব্রিসবেনের মেয়ে হলেও মেলবোর্ণ তার পছন্দের। মেলবোর্ণের পরিবেশ প্রকৃতি তাকে বেশ টানে।
ভারতবর্ষে এসেছিলো একবার তাজমহল দেখতে। বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে তবে খুব বেশি নয়। জানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ইতিবৃত্ত। এমনকি বিশ্বসেরা ম্যানগ্রোভ নিয়েও কথা বলল। জানতে চাইল রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা। জুলিয়ানের সাথে কথা হচ্ছিল কান্তাস এয়ালাইন্সের মেলবোর্ণগামী ফ্লাইটে।
সম্প্রতি জুলিয়ান কাজ করছে পাখি নিয়ে। বিশেষ করে ময়ুরের সুরক্ষা। প্রায় দুইশ বছর আগে বৃটিশরা অস্ট্রেলিয়ায় ময়ূর নিয়ে আসে। সেই থেকে বেশ আছে ময়ূরকূল। প্রচুর গাছপালা থাকায় অনায়াসে ঘুরে বেড়ায় শহরজুড়ে। বছর দুই আগে সরকার ময়ূরের সংখ্যা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলো কিন্তু পাখিপ্রেমিরা বাধ সাধে। যদিও কেউ কেউ ভবঘুরে ময়ূরের যন্ত্রণায় অতীষ্ট।
কান্তাস এয়ারের বিশালাকার ফ্লাইটটি অবতরণের আগে মেলবোর্ণের আকাশে চক্কর দিল। ডিম্বাকৃতির জানালা দিয়ে চকিতে দেখা যায়, শেষ বিকেলের লাজরাঙা আলো শহরের দালানগুলোর শীর্ষে। গোধুলির আভা শরীরে মেখে ওয়েলিংটন থেকে উড়ে আসা বায়ুতরি স্পর্র্শ করে মেলবোর্ণের মাটি।
অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। চারটি টার্মিনাল বিশাল এলাকাজুড়ে। বন্দরসেবায় অনাবশ্যক সময়ক্ষেপন নয়। দ্রুতলয়ে পার হচ্ছে যাত্রীরা। প্রত্যাশার বেশি সেবা পাওয়ায় আমাদের মনও ফুরফুরে। এগারজনের দলটি যখন বেরিয়ে এলাম, তখন জ্বলে উঠেছে চোখ ধাঁধানো আলো। প্রশস্ত সড়ক, সুবিন্যস্ত। লেইন ধরে এগিয়ে চলছে যন্ত্রযান। নতুন শহর দেখার ঔৎসোক্য। আমাদের গন্তব্য এলবার্ট পার্ক লেক সংলগ্ন হোটেল মারকিওরে মেলবোর্ণ। শহরের প্রাণকেন্দ্র ছুঁয়ে যেতে হবে। এয়ারপোর্টটি শহরকেন্দ্র থেকে তেইশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। বহুলেন বিশিষ্ট এক্সপ্রেসওয়েটি ভূমি থেকে কিছুটা উঁচুতে। দুপাশের সুউচ্চদালানগুলোর শরীরে উজ্বল সোনালী-আলো। আলো শহরজুড়ে। যানবাহনের সম্মুখ আর পশ্চাতের দুরকম আলোয় জানান দেয় জীবনের দুই গন্তব্য। আসা আর যাওয়া।
ওয়েলিংটন থেকে মেলবোর্ণ, খুব বেশি সময়ের ভ্রমণ নয়। তারপর এয়ারপোর্ট হতে হোটেল তক পৌছতে ত্রিশ মিনিট। হোটেলের পরিচ্ছন্ন, সুপরিসর লবি। আধুনিকতা আর আভিজাত্যের ছোঁয়া স্পষ্ট। খুব একটি ক্লান্তি ভর করেনি শরীরে।
ফ্রেশ হয়ে ঝটপট নেমে এল সবাই। ট্যুর সমন্বয়ক রবিউল সাহেব জানালেন, দেরি হলে ডিনার পেতে সমস্যা হবে। আগে পেটের সুরক্ষা, পরে চিত্তের সুখ। বেশিদূর যেতে হলনা, পাওয়া গেল কেএফসি। বিদেশ বিভুঁইয়ে কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস আর সাবওয়ে যে কত আপন! তা ভুক্তভোগী কিংবা অভূক্তরাই বোঝেন!
পোর্ট ফিলিপ বে আর বহতা ইয়ারানদীর স্নেহধন্য মেলবোর্ণ। ওদিকে দক্ষিণে অপার মমতায় ঘিরে আছে ভারত মহাসাগর। এমন জলসংলগ্ন শহরে খাবার তালিকায় মাছই প্রাধান্য পাবে, এটাই স্বাভাবিক। দলের সাথে মিনিবাস চালক মোস্তফা। মোস্তফা বিক্রমপুরের ছেলে। একদশক ধরে এখানে। কাজের ফাঁকে অবসরে গাড়ি চালান বাড়তি আয়ের আশায়। বাংলাদেশ থেকে টিম আসছে জেনে আগ্রহ বাড়ে তার। দেশের মানুষের সাথে কথা বললে নাকি তার প্রাণশক্তি বাড়ে!দেশের ছোঁয়া পাওয়া যায়।
জগতজুড়ে মেলবোর্ণের কফির খ্যাতি। এখানে এসে কফির স্বাদ নিতে জিহ কেমন যেন করছিলো। ডিনার শেষে মোস্তফা খুঁজে বের করল কফি শপ। এসপ্রেসো হাতে নিয়ে গাড়িতে বসলাম। চুমুকেই স্বস্তি। বলছিলো মোস্তফা, শহর মেলবোর্ণের কথকতা।
বিশাল দেশ অস্ট্রেলিয়া। শুধু মূল ভূখন্ড বায়ান্নটি বাংলাদেশের সমান। আর জনসংখ্যা আড়াই কোটি। দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত শহর মেলবোর্ণ ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী। মোট ছয়টি অঙ্গরাজ্য। এর বাইরে মূলভূভাগে তিনটি এবং বাইরে সাতটি টেরিটরি রয়েছে। রাজধানী ক্যানবেরা ফেডারেল সরকার শাসিত একটি টেরিটরির অংশ। জনসংখ্যার দিক দিয়ে সিডনীর পরেই মেলবোর্ণ। ব্যাক পেকার্সদেরও প্রিয় গন্তব্য মেলবোর্ন শহরের গোড়াপত্তন ১৮৩৫ সালে। প্রাচীন এ শহরে প্রায় ছেষট্রি লাখ মানুষের বাস। তাদের হিসেবে ঘণবসতিপূর্ণই বলা চলে।
গাড়ি ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে শহরকেন্দ্রে। আমাদের হাতে সময় কম। ক্যানবেরা যাওয়ার পথে স্বল্পসময়ের স্টপওভার মেলবোর্ণে। মাত্র একরাত একদিন। বলা যায় ঝটিকা সফর। তাই প্রতি সেকেন্ডই মূল্যবান। আমাদের আপাত গন্তব্য ইউরেকা স্কাই ডেক। শহরের সবচেয়ে উঁচু দালান। দালান এ কারণে বলছি, এটা একটা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। মেলবোর্ণের সর্বোচ্চ ভবন, অস্ট্রেলিয়ায় তৃতীয়। স্রোতস্বিনী ইয়ারা নদী শহরকে দুভাগ করেছে উত্তর আর দক্ষিণে। ইউরেকা টাওয়ারের অবস্থান উত্তর তীরে। নয়শ পঁচাত্তর ফুট উচ্চতা তথা একানব্বই তলার আকাশচুম্বি ভবনটি চালু হয় ২০০৬ সালে। এ ভবনের সাতাশি তলা পর্যন্ত এপার্টমেন্টে মানুষের বসবাস। ঠিক যেন মেঘের রাজ্যে আকাশ বাড়ি!
রোমাঞ্চকর স্কাইডেকের অবস্থান আটাশি তলায়। দ্রুতগতির লিফট-এ মাত্র আটত্রিশ সেকেন্ডের উর্ধ্বমূখি যাত্রা। ডেকটি সবার জন্য উন্মুক্ত তবেউঠতে হলে নির্দিষ্ট ফি গুণতে হয়। ডেকের উপরের ফ্লোরে রেস্টুরেন্ট। তারও উপরে আরেকটি ফ্লোর অফিসিয়াল কাজে ব্যবহারের জন্য। স্কাইডেক-৮৮ থেকে দেখা মেলবোর্ণ এক লাস্যময় নগরী। নগরীর শরীর থেকে ঠিকরে পড়ছে বর্ণিল আলোর দ্যুতি। পরিচ্ছন্ন মেঘমুক্ত রাতের আকাশ। দূরকে কাছ থেকে দেখতে রয়েছে ত্রিশটির বেশি দূরবীক্ষণ যন্ত্র। সোনালী রঙের ফ্রেমে আয়না ঘেরা ডেক। দেখা যায় ঝলমলে মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ফিলিপ বে, বন্দরসহ নগরীর বিখ্যাত সব স্থাপনা। আয়নায় ঘেরা একটি কিউবে চড়ে বসতে পারেন। তবে একটু সাহস করতে হবে। কিউবটি মূলভবন থেকে আরেকটু বাইরে নিয়ে যাবে আপনাকে। অস্বচ্ছ কাঁচের ঘণকটি ধীরে ধীরে বের হবে আর স্বচ্ছ হতে থাকবে। উদ্ভাসিত হবে বহির্দৃশ্য।বিকেলে পর্যটক আর দর্শনার্থীরা ভিড় করে স্কাই ডেকে। সূর্যাস্ত আর শহরজুড়ে সন্ধ্যা-আলো জ্বলে ওঠার দৃশ্য উপভোগ করেন তারা। ঘড়ির কাটায় তখন দশটা ছুঁই ছুঁই। আমাদের নেমে আসতে হবে আকাশ থেকে।
গন্তব্য এবার বিখ্যাত ’ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট’। ম্যাথিও ফ্লিন্ডার্স একজন অনুসন্ধানকারী। আবিস্কারের নেশায় ছুটে চলতেন দিগি¦দিক। তিনিই নামকরণ করেন অস্ট্রেলিয়ার। গ্রীক শব্দ অস্ট্রালিস থেকে অস্ট্রেলিয়া, যার অর্থ সাউদার্ন। তার নামেই ফিল্ডার্স স্ট্রিট। ঐতিহ্যের ছোঁয়া পেতে এ সড়কে ছুটে আসেন পর্যটকরা।
সড়কটি ইয়ারা নদীর সমান্তরালে। শহরের বেশকিছু বিখ্যাত এবং প্রাচীন স্থাপনা এ সড়কে। এর মাঝে সেন্ট পলস্ ক্যাথেড্রল, পুরাতন হেরাল্ড এবং সাপ্তাহিক টাইমস্ এর সদর দপ্তর ভবন, মেলবোর্ণ একোয়ারিয়াম, ব্যাটম্যান পার্ক উল্লেখ করার মতো। তবে যে কারণে আমাদের এ সড়কে আসা সেটা হল ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট স্টেশন। মেলবোর্ণতো বটেই, এটি অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম রেল স্টেশন।প্রশস্ত সড়ক মোহনায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় একশ’ পঁয়ষট্রি বছরের পুরাতন স্টেশন ভবন। আলোর দৃষ্টিনন্দন প্রক্ষেপন ভবনটিকে দেখাচ্ছে চিরযৌবণা। মোগল স্থাপত্যে গড়া ভবনের শরীরজুড়ে সোনালী রঙ আর জানালায় লাল। উপরে গম্বুজ। স্টেশনের সাতশ’ আট মিটার দীর্ঘ ফ্ল্যাটফর্ম এখনও অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘতম ফ্ল্যাটফর্ম।
প্রাচীন সড়কের ঐতিহ্য গায়ে মেখে মোস্তফা আমাদের নিয়ে যায় মেলবোর্ণবাসীর অহংকার মেলবোর্ণ ক্রিকেট গ্রাউন্ড, সংক্ষেপে এমসিজি এলাকায়। বিশাল এলাকাজুড়ে স্টেডিয়াম। এটি মূলত ইয়ারা পার্ক এলাকায় অবস্থিত। সিটি সেন্টারের অদূরে। বিশাল এ স্টেডিয়ামের ধারণ ক্ষমতা প্রায় একলাখ। ১৮৫৭ সালে গড়া স্টেডিয়ামটি মেলবোর্ণবাসীর মনপ্রিয়, আনন্দের উৎস। ক্রিকেটছাড়াও অস্ট্রেলিয়ান রোলস ফুটবল, সকার, রাগবি ইউনিয়ন লীগ, লোন বল, স্কোয়াসসহ অন্যান্য লীগেও এ মাঠ ব্যবহার হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের সময় এটি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ মাঠে প্রথম ক্রিকেট টেস্ট অনুষ্ঠিত হয় ১৮৭৭ সালে। প্রথম একদিনের ম্যাচ হয় ১৯৭১ সালে। ২০০৮ সালে প্রথম টি-টুয়েন্টি ম্যাচ।
জগতের তাবত বন্দর শহরগুলো জমে ওঠে রাতে। বন্দরে বাঁধা বহুজাতিক জাহাজের নাবিক আর কর্মিরা নগদ অর্থে কেনে জীবনের জৌলুস। মেলবোর্ণও ব্যতিক্রম নয়। নাইট লাইফ মাত্র জমে উঠতে শুরু করেছে। ব্যস্ততার মোড়কে নগরকেন্দ্র। রাতের মেলবোর্ণ দিনের চেয়ে স্বভাবতই অধিকতর অনুনাদশীল। বার, নাইট ক্লাব, মিউজিকবারগুলো জম্পেস। তাইতো মেলবোর্ণ বিশাল অস্ট্রেলিয়ার সাংস্কৃতিক রাজধানী। এখানে আছে বেশকিছু মিউজিয়াম। সড়ক, গলির পাশের দেয়ালে নানান রঙে আঁকা দেয়ালনকশা। কফি-শপগুলো জীবন্ত হয়ে উঠছে রাত বাড়ার সাথে সাথে। বিয়ার আর কফির ঘ্রাণ অলি-গলি মাড়িয়ে রাজপথে। প্রাণবন্ত মানুষেরা গ্রহণ করছে জীবনের রূপ, রস। স্বল্পবসনা লাস্যময়ী তরূণীদের ভাবনাহীন, অসঙ্কোচ চলাচল মনে করিয়ে দেয় এক নিরাপদ নগরীর কথা। গলির দুপাশে সারি সারি কফি শপ, বার। হেঁটে চলা গলির ফুটপাতে সাজানো টেবিলে উদ্বেগহীন সুখিমানুষের মেলা। মিনি স্কার্ট পরা রমনীসকল পায়ের ওপর পা বসিয়ে ঠোঁটে গোঁজা সিগারেট থেকে ধোঁয়া ছাড়ে উর্ধাকাশে। বছরের পর বছর তাইতো মেলবোর্ণ ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জরিপে বিশ্বের বাসযোগ্য নগরীর তালিকায় শীর্ষস্থান দখলে রেখেছিলো।
মায়াবতি এ শহরের মায়া চোখের তারায় মেখে মাঝরাতে ফিরে আসি হোটেলে। গা এলিয়ে দেই বিছানায়। মনের দ্বারে ভাসতে থাকে সুখি মানুষগুলোর জীবন উপভোগের উপচে পড়া পেয়ালা।
দুই,
প্রত্যুষেই ঘুম ভাঙ্গলো। মনজুড়ে মায়ারি শহরের মায়া। গতরাতের সুখস্মৃতির জাবর কাটতে কাটতে আড়মোড়া ভাঙ্গল। উঠে পর্দা সরিয়ে দিলাম। যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। রুম সাইজের বিশাল জানালা। সামনে অবারিত সবুজ। একেবারে হাতের নাগালে। শুধু সবুজই নয়, জল টলমল এলবার্ট হ্রদ।
কাক চক্ষুর মতো স্বচ্ছ জল চোখের সামনে। যতদূর দেখা যায় ওপারে ঘন সবুজ। পাশে গলফ কোর্সের মোজাইক গ্রিন। ঝটপট নেমে এলাম। তখনও শহরের চোখ ফোটেনি। সুনসান নিরবতা চারদিকে। রাস্তা পেরিয়ে ঘনসবুজের দিকে এগিয়ে গেলাম। স্বাস্থ্য সন্ধানী জগাররা জুটি বেঁধে দৌড়াচ্ছে। পাশ দিয়ে সাঁ সাঁ শব্দ তুলে চলে গেলো একদল সাইক্লিস্ট। বিশাল এলাকাজুড়ে লেক এলবার্ট। অপরপাশে ঘনসবুজ বন। লেককে ঘিরে গড়ে উঠেছে স্পোর্টস জোন। বোঝার উপায় নেই এর মধ্যেই আধা ডজন ডিম্বাকৃতির খেলার মাঠ। পার্ক ঘিরে মসৃন পাকা সড়ক। এটি আসলে মেলবোর্ণ গ্র্যান্ডপিক্স এর সার্কিট। একপাশে মেলবোর্ণ স্পোর্টস সেন্টার অফিস। তার পাশেই স্পোর্টস সেন্টার ক্রিকেট স্টেডিয়াম। আরেকটু বামে এগুলে ইনডোর বাস্কেটবল কোর্ট। আরো একটি দৃষ্টিনন্দন ক্রিকেট মাঠ, যার নাম সেন্ট কিল্ডা ক্রিকেট গ্রাউন্ড। আছে হকি খেলার মাঠ। মূলত শহরটি অস্ট্রেলিয়ার খেলাধুলার রাজধানী।
লেকের স্বচ্ছ জলরাশিতে সারি করে বাঁধা স্পীডবোট আর ছোট আকারের জলযান। সকালের মৃদু বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে। ততক্ষণে দিবসের আলো ছড়াতে শুরু করেছে চিরদিবসের দিবাকর। মিষ্টি রোদের ছোঁয়ায় যেন জেগে উঠছে লেক এলবার্ট। ঢেউয়ের ওপর পড়ছে সকালের কোমল সূর্যালোক। চিক চিক করছে মুক্তোদানার মতো। হাতের মোবাইলে দেখলাম সময়ও কম যায়নি।
দ্রুতলয়ে হাটলাম হোটেলের দিকে। আজ আমাদের গন্তব্য ’গ্রেট ওশান রোড’।
মেলবোর্ণের আবহাওয়ার খুব বদনাম আছে। যার সম্পর্কে আগে থেকে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায়না। তবে কথায় বলে মর্নিং শোজ দ্যা ডে। ঝলমলে সকাল দেখে মনেই হবেনা এখানকার বোহেমিয়ান আবহাওয়ার কথা। আবহাওয়াবিদরা অবশ্য মেলবোর্ণের আবহাওয়াকে বলেন, ’ফোর সিজনস ইন অ্যা ডে’। হালকা শীত পড়ছে, তবে জ্যাকেট পরার মতো নয়। গুগল ওয়েদার বলছে এখন চৌদ্দ ডিগ্রি। বিকেল নাগাদ তাপমাত্রা নামতে পারে। হালকা বাতাস অবশ্য জানান দিচ্ছিল কিছুটা।
আমাদের সন্ধ্যা সাতটায় ধরতে হবে ভার্জিন অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাগামী ফ্লাইট। দুঘন্টা আগে বিমানবন্দরে পৌছতে হবে। তবুও চ্যালেঞ্জ নিলাম। মেলবোর্ণ এসে জগতখ্যাত ’গ্রেট ওশান রোড’ মিস করার মতো বোকামি করা যাবেনা!
গাট্টি-বোঁচকাসহ সকলেই প্রস্তুত। শেষ হল হোটেল থেকে বিদায় পর্ব। গ্রেট ওশান রোড অভিমূখে যাত্রা। সুনসান শহর নিরবতার চাদরে মোড়ানো। ছবির মতো গোছানো আবাসিক এলাকা। প্রশস্ত রাস্তার দুপাশে সাজানো ছোট ছোট বাড়ি। সামনে পেছনে খোলা জায়গা। আফসোস হয়! এত জায়গা পড়ে আছে! আর আমাদের ছোট্ট একটি দেশ! মৌমাছির চাকের মতো ভন ভন করে ঢাকা শহরে মানুষের কোলাহল।
শহর পেরিয়ে শহরতলি। শহরতলি পেরিয়ে বিস্তীর্ন ভূমি। জনমানবহীন। এরপর আমাদের কাছে টেনে নিল সুনীল সাগর। সাগরের তীর পাহাড়ের ঢালে মজবুত সড়ক। বাঁয়ে সাগরের জলরাশি ডানে উঁচু পাহাড়। পাহাড় কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে দুইশ তেতাল্লিশ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়ক। জগতের দীর্ঘ ওয়ার মেমোরিয়াল।
সড়কটি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ঐতিহ্য তালিকাভূক্ত। দুর্গম এ পথে সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯১৯ সালে, শেষ হয় ১৯৩২ সালে। যুদ্ধফেরত সৈনিকদের দায়িত্ব দেয়া হয়। নির্মাণ কালে প্রাণ হারাতে হয় অনেক কর্মিকে। সড়কের একপ্রান্তে ভিক্টোরিয়া রাজ্যের টারকোয়ে, অপরপ্রান্তে অ্যালান্সফোর্ড। গাড়ি এগিয়ে চলে সড়ক ধরে। বিস্ময় যেন ছায়াসঙ্গী হয়ে সাথে চলে। অবিশ্বাস্য কর্মকূশল আর দক্ষতায় নির্মিত সড়ক। সুউচ্চ পাহাড়ের গা ঘেঁষে এগিয়ে চলে আঁকা বাঁকা কখনো মাথার সিঁথির মতো। মাঝে মাঝে অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য উপভোগের জন্য তৈরি করা আছে অবলোকন কেন্দ্র। আমরা কিছুদূর গিয়ে মনোরম দৃশ্য দেখে থামি। হয়তো পরে এমন দৃশ্য পাবো না। ছবি তুলি। কিন্তু হায় যত এগোই ততই সুন্দর। মনে হয় সদ্য পেরিয়ে আসা পথের চেয়ে চলমান পথই অধিকতর নয়ন মনোহর।
এরই মাঝে আমার যুৎসই দেখে এক জায়গায় থামলাম। এখানে সড়ক থেকে সৈকতে নামার সিঁড়ি করে দেয়া আছে। পাহাড়ের ঢালে মনোরম রিসোর্ট। সূর্যের আলো এসে পড়ছে রিসোর্টের কটেজগুলোর বারান্দায়। যেন এক স্বর্গীয় দৃশ্য। সৈকতে নেমে পড়ি দলবলে। সকলের উচ্ছাস জানান দিচ্ছিল বয়সের ফ্রেমে মনের আনন্দকে আটকে রাখা যায়না। সাগরে চলছে ভাটা। দীর্ঘ বালুচর পেরিয়ে আমাদের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাস গিয়ে থামল জলরেখার প্রান্তে। উড়ন্ত সমুদ্র সারসের ঝাঁক উড়ে এসে যেন স্বাগত জানাল। হয়তো খাবারের সন্ধানেই এসেছে। একটি দলছুট সারস থেকে গেল আমাদের কাছেই। সরছে না। আমরা হাঁটি বালুচরে, জলরেখায়। পাখিটিও আমাদের সাথে পা ভিজিয়ে হাঁটে। ঢেউভাঙ্গা সফেদ ফেনা আর নীল জলরাশির ক্যানভাসে সাদা কালো ডানার সাদা রঙের বুক আরঠোঁটের পাখিটিকে কি যে অপরূপ লাগছিল! ছেড়ে আসতে মন সায় দিচ্ছিলনা।
গাড়ি এগোয়। কখনো বনবীথি। কখনো উন্মুক্ত আকাশ। কখনো দুপাশে সাগর আর পাহাড়। আহা এ পথ যদি না শেষ হয়! এ পথ যেন শেষ হবার নয়। এরই মাঝে এপোলো বে’র তীর ঘেঁষে ছোট্ট পাহাড়ি শহরের দেখা পেলাম। পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট বাড়ি। সাজানো ছবির মতো।
আমরা পৌছে গেলাম দৃষ্টিনন্দন লর্নি বিচ-এ। সাগর বেঁকে ঢুকে গেছে পাহাড়ের কোলে। এখানটায় তৈরি হয়েছে খাড়ির মতো। প্রশস্ত বালুচর। পাহাড়ের গা ঘেঁষে অবকাশ কেন্দ্র। এরপর সৈকত ঘেঁষে লর্নি ক্লিফ রিজার্ভ। সাজানো ছবির মতো সাগর সৈকত। মাছ শিকারিদের জন্য জলরাশির দিকে তৈরি করা হয়েছে দীর্ঘ ডেক। মজবুত কাঠামোর ওপর কাঠের পাটাতন। শেষপ্রান্তে একাধিক তলার পাটাতনে বসে বড়শি ফেলার সুযোগ সাগর জলে। যেখান থেকে ঢেউ তৈরি হয় তা পেরিয়ে অনেকটা সাগরের মাঝে ডেকের মাথা এসে পৌছেছে। তীব্র বাতাস কন কনে শীতকে উস্কানী দিচ্ছে। তাপমাত্রা দ্রুত কমে এসেছে। এরই মাঝে হালকা বৃৃষ্টি পড়তে শুরু করছে।
মাঝদুপুরে বীচে ছোটাছুটি আর জলমুগ্ধতায় ক্ষিধের কথা ভুলতেই বসেছিল পেয়ে বসা মধ্যবয়সি ’তারুণ্য’। গাড়ি গিয়ে পৌছলো পাহাড় শীর্ষের ছোট্র এক শহরে। রিসোর্ট ভ্যালি বলা যায়। বিশাল এলাকা জুড়ে ফুড কোর্ট। সারি সারি খাবার দোকান। অসংখ্য গাড়ি পার্ক করা। না এলে বোঝার উপায় নেই এত পর্যটক এখানে! পর্যটকদের চেহারায় মনে হচ্ছে বেশির ভাগই চায়নিজ। পার্কিং এর পাশে সুদৃশ্য পার্ক। শিশুদের জন্য নানান ধরনের রাইডস। ওদিকে পাহাড় শীর্ষে বিশাল গীর্জা। গীর্জার ঘন্টা জানিয়ে দিল ইতোমধ্যে একটা বেজেছে। ত্রিশ মিনিটের মাঝে লাঞ্চ সারতে হবে আমাদের। দলনেতা জানালেন কুইক লাঞ্চের আহবান।
দেখেশুনে বসে পড়লাম আমরা। আউটলেটের নাম, ফিশ এন্ড চিপস্। নামকরণের মাঝেই খাবার মেন্যু। বেশি সময় নেয়া যাবেনা। এরই মাঝে থেকে থেকে ইলশেগুঁড়ি ঝরছে। প্রায় তিন ঘন্টার মতো ভ্রমণ করেছি আমরা। ফিরে যেতে সমান সময় লাগার কথা। আমাদের তাড়া দেখে বোধ হয় মায়া হচ্ছিল আমাদের গাইড কাম গাড়িচালক ইন্দ্র’র। ইন্দ্র ভারতীয়। উড়িষ্যার ছেলে। সে অভয় দিচ্ছিল বারবার। ফেরার পথে কোনাকোনি পথ ধরবে। বড় জোর দুই থেকে সোয়া দুই ঘন্টায় এয়ারপোর্ট ধরিয়ে দিবে।
মায়াময় মুগ্ধতা ছেড়ে শুরু হল ফেরত যাত্রা। এবার আমরা ভিন্ন পথ বেছে নিলাম। পাহাড় সাগর ছেড়ে অরণ্যপথ। এপোলো বে হয়ে ঢুকে পড়লাম পার্বত্য পথে। অরণ্য মাঝের পিচঢালা পথে ছুটছে গাড়ি। বিশাল এলাকাজুড়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওটঅয়েজ বনাঞ্চল, যা ওটঅয়েজ ফরেস্ট পার্ক নামে পরিচিত। প্রথমদিকটায় বিচ্ছিন্ন কিছু জনবসতির নিদর্শন মিললেও ক্ষণিক পরে তার লেশমাত্র নেই, কারণ ঘন বন শুরু। অনেক উঁচুতে সড়ক। নীচে গভীর খাদ। সুউচ্চ বৃক্ষগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে স্পষ্ট বয়সের ছাপ।
ক্লান্তি ভর করেছিল চোখের ডগায়। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি। সহযাত্রী তারিক ভাই যখন ঠেলা দিয়ে বললেন, আপনি আরেকটু ঘুমিয়ে নিন। আমরা যাচ্ছি। চোখ মেলে দেখলাম, গাড়ি এয়ারপোর্ট পার্কিং-এ। হাতে ভালসময় আছে। হালকাচালে আমরা ঢুকে পড়লাম বন্দরে।
ভার্জিন অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাগামী ফ্লাইটটি ডানা মেলল মায়াবি শহর মেলবোর্ণের আকাশে। তখনও মেঘমালার উপর খেলছে ম্রিয়মান সূর্যের আলো।
===
লেখক: লেখক ও গবেষক