লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি : লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মেঘনাপাড়ের ৯টি মাছঘাটে জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। ঘাটগুলোর আড়তে মাছ বিক্রির কমিশনের নামে শতকরা ৬ থেকে ৮ টাকা হারে বিনা রশিদে এ চাঁদা আদায় করছেন ঘাটের লোকজন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ভাগাভাগি করে এ ঘাটগুলোর নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের নামেই পরিচিতি ঘাটগুলোর।
এদের মধ্যে কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বছরে ৫শ’ টাকা দিয়ে একটি মাছের আড়তের ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই তারা এসব করে যাচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন জেলেরা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অপরদিকে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। দাদনের বেড়াজালে আবদ্ধ বহু জেলে ঘাটগুলোতে মাছ বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ঘাটগুলোতে মেঘনায় মাছ ধরতে আসা রায়পুর, লক্ষ্মীপুর সদর, ভোলা, বরিশাল, শরিয়তপুর ও চাঁদপুরের কয়েক হাজার জেলে মাছ বিক্রি করে থাকেন। গত কয়েকদিন দিন ধরে মেঘনাপাড়ের মাছঘাটগুলো সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের মাছঘাটগুলো হলো- চর জালিয়ার গ্রামে সাইজুদ্দিন মোল্লা মাছঘাট, চর ইন্দুরিয়া আলতাফ মাষ্টারের মাছঘাট, আলতাফ মাষ্টারের বাইরের ঘাট, পুরান বেড়ি মাছঘাট, দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের হাজীমারা মাছঘাট, পানিরঘাট মাছঘাট, মিয়ারহাটে রাহুল মাছঘাট ও টুনুর চরে দিদার মোল্লা মাছঘাট।
এগুলোর মধ্যে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলতাফ মাষ্টারের মালিকানায় উত্তর ও দক্ষিণ চরবংশীতে ৪টি। পুরান বেড়ির ঘাটটিতে মাষ্টারের সঙ্গে আলাদা টেবিল রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা খালেদ দেওয়ান, ওসমান খানের টেবিল, আওয়ামী লীগ নেতা মফিজ খাঁনের টেবিল, রতন হাওলাদারের টেবিল, বাচ্চু খাঁনের টেবিল। উত্তর চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইজ উদ্দিন মোল্লা ও আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল সরদারের মালিকানায় একটি। দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মনির হোসেন মোল্লা ও সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির হোসেন মোল্লার মালিকানায় পৃথক দু’টি মাছঘাট রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল রাহুলের মালিকানাধীন নতুন মাছঘাট ও যুবলীগ নেতা দিদার মোল্লার মালিকানাধীন টুনুর চরে মোল্লা মাছঘাট।
কথা হয় জেলে আ. হক মাঝি, আমিন উদ্দিন বেপারী, রফিজল হক, আয়নাল খান, জাহাঙ্গীর পাইক ও দুলাল ছৈয়ালের সঙ্গে। তারা বলেন, আমরা কষ্ট করে নদীতে ভিজে, রোদে পুড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরি। সেই মাছ বেচতে আসলে উল্টো আমাদের কাছ থেকেই শতকরা ৮ টাকা করে কেটে রাখা হয়। এ জন্য কোনো রশিদ দেয়া হয় না। এ টাকা না নিলে এটা দিয়ে হয়তো আমাদের এক বেলার সংসার খরচও হয়ে যেতো। আমরা দাদন না নিলেও বাধ্যতামূলকভাবে কমিশনের নামে টাকা দিতে হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে উল্টো মার খেতে হবে।
মাষ্টার ঘাটের কর্মচারী জয়নাল আবেদীন বলেন, প্রায় একশ’ জেলের কাছে আমাদের ৮০ লাখ টাকার মতো দাদন রয়েছে। তারাই আমাদের এখানে মাছ বেচতে আসেন। তাদের কাছ থেকে আমরা ৮ টাকা করে কমিশন নেই। একই সাথে তারা বিনা সুদে দাদন নেয়া টাকা ধীরে ধীরে জমা করেন। দাদন নিয়ে অনেক জেলেই আর আসেন না। এভাবে আমাদের প্রায় ২০ লাখ টাকা তারা মেরে দিয়েছেন তারা।
উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, রায়পুর উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৭ হাজার ৫শ’। এদের মধ্যে জাটকা জেলে বা নদীর উপর নির্ভরশীলদের মধ্যে রয়েছেন ৬ হাজার ৮৫০ জন। ঘাটগুলোতে মৎস্য অফিসের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি নেই।
উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. ইউসুফ হোসেন জানান, এ ইউনিয়নে ৬ জনের নামের মাছের আড়তের ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে। ৫শ’ টাকা করে ফি জমা দিয়ে এক বছরের জন্য এ লাইসেন্স দেয়া হয়। এর মধ্যে আলতাফ মাষ্টারের নামে ৪টি, রতন হাওলাদার ও বাচ্চু খাঁনের নামে একটি করে লাইসেন্স রয়েছে। অন্য কারো নাম এখানে নিবন্ধিত নেই।
দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব তছলিম উদ্দিন জানান, আমার ইউনিয়নে ৪টি মাছঘাট থাকলেও কোনো ব্যক্তি এখন পর্যন্ত মাছের আড়তের জন্য ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেননি।
মনির হোসেন মোল্লা বলেন, আমিসহ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ৬ জন পানিরঘাট চালাই। এ ঘাটে আগের মতো জেলেরা আসেন না। প্রায় শতাধিক জেলে এ ঘাটে শতকরা ৫ টাকা করে দিয়ে থাকেন।
সাইজ উদ্দিন মোল্লা বলেন, আমি চরভৈরবীর আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমি মেম্বার ও শিল্পপতি শওকত আলী বাবুল মিলে ঘাটটি চালাই। ঘাটে আসা মাছ বিক্রয়কারী জেলেদের কাছ থেকে শতকরা ৮ টাকা করে কমিশন নেয়া হয়। এছাড়া এখন আর আগের মতো জেলেদের সমাগমও নেই।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাষ্টার আলতাফ হোসেন হাওলাদার বিএসসি বিষয়টিতে কোনো সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানিয়ে বক্তব্য দেবেন না বলে জানান।
রায়পুর থানার ওসি আবদুল জলিল বলেন, এ ধরনের ঘটনা কেউ আমাদেরকে জানায়নি। বিষয়টি যাচাই করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরীন চৌধুরী বলেন, জেলেদের কাছ থেকে মাছ বিক্রি বাবদ টাকা আদায়ের বিষয়টি জানা নেই। বিষয়টিতে খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রায়পুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ মামুনুর রশিদ বলেন, অবৈধ মাছঘাটগুলোর কারণে সরকারের জাটকা নিধন প্রতিরোধ ও মা ইলিশ রক্ষা আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয়। ইজারার আওতায় না থাকায় সরকারও রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলেরা। দলীয় পদবী বা প্রভাব খাটিয়ে কাউকে এ ধরনের মাছঘাট দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায় দল নিবে না।